প্রাথমিকে এক শিফটে পাঠদানে নারাজ শিক্ষক-অভিভাবক

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এক শিফট চালুর নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ক্লাসরুম থাকা বিদ্যালয়গুলোতে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। যেখানে সংকট রয়েছে তার এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্য বিদ্যালয় থাকলে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে শিক্ষার্থী ভাগাভাগি করে।
তবে শিক্ষার্থী ভাগাভাগি করে অন্য বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবভিত্তিক নয় বলে মনে করেন শিক্ষক-অভিভাবকরা। এতে শ্রেণি শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সক্ষতা নষ্ট হবে। বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেড়ে গেলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে যাবে বলে মনে করেন তারা।
ডিপিই থেকে জানা যায়, সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এর মধ্যে আট হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু রয়েছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান জানান, ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা, দূরত্ব, শিফট ইত্যাদি বিবেচনায় কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একীভূত করা হবে। ছাত্র কম শিক্ষক বেশি, শিক্ষক কম ছাত্র বেশি- এমন ভারসাম্যহীন অনেক স্কুল রয়েছে দেশে। নিকটবর্তী স্কুলগুলো নিয়ে যদি শ্রেণি একীভূত করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘণ্টা বেশি হবে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে গত ৪ জানুয়ারি সক্ষমতাসাপেক্ষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষক জানান, এক শিফটে ক্লাস নিতে ন্যূনতম ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে চার-পাঁচজন করে শিক্ষকের পদ সৃজন রয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট নিয়েই চলছে পাঠদান। অনেকে ব্যক্তিগত কাজ, বিদেশ ভ্রমণ, অসুস্থতাসহ নানান কারণে ছুটিতে থাকছেন। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে কোনোমতে সেখানে পাঠদান চালিয়ে নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে অনেক স্থানে এক শিফট চালুর জন্য নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক রয়েছেন, সেগুলোতে অবিলম্বে এক শিফট চালু করতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নেই বা উভয়ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে, সেসব বিদ্যালয়ের বিষয়ে বিকল্প একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হলো, সর্বোচ্চ এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এমন দুটি বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে একক পালায় (শিফট) পাঠদান পরিচালনা করা। আর এই বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়ে এবং অন্যটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানোর পরিকল্পনা আছে। তবে বিষয়টি এখনই চূড়ান্ত না করে চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করে বিস্তারিত তথ্যসহ (গাণিতিক ও বাস্তবতা) প্রতিবেদন পাঠাতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে ডিপিই।

ঢাকার শেরেবাংলা নগর শিশু শিক্ষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শামসুর নাহার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে গত তিন মাস আগে প্রধান শিক্ষক অবসর নেওয়ার পর আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে মাত্র চারজন শিক্ষক দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ থাকলেও রয়েছে শিক্ষক সংকট।
তিনি বলেন, এক শিফটের ক্লাস চালু করতে হলে ন্যূনতম ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। এছাড়া এটি চালু করা সম্ভব হবে না। সে কারণে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষার্থী নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তারা নিয়মিত ক্লাসে এসে পরিচিত শিক্ষকের কাছে পড়তে চায়। হঠাৎ করে নতুন বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চাইবে না। এতে উপস্থিতি কমে যাবে।

অভিভাবকরাও এতে রাজি নন। তার ওপর দুই শিফটে ক্লাসে পুরো সময় শিক্ষার্থীরা থাকতে চায় না। এক শিফটে ক্লাস চালু হলে অনেকে ক্লাস শেষ হওয়ার আগে চলে যাবে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।
শেরেবাংলা শিশু শিক্ষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক নাসরিন বেগম জাগো নিউজকে বলেন, বাসার পার্শ্ববর্তী স্কুল হওয়ায় এখানে আমার মেয়েকে ভর্তি করেছি। এখানে শিক্ষকরা খুব যত্ন সহকারে শেখান। বিদ্যালয়ের শিক্ষক আপারা বলছেন পার্শ্ববর্তী এক কিলোমিটারের মধ্যে কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে দেওয়া হবে। এখন যদি আমার মেয়েকে অন্য স্কুলে দেওয়া হয় তাতে বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, আমার স্বামী ব্যবসা করে, আমি একটি এনজিওতে চাকরি করি। সে কারণে মেয়েকে একাই স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়। স্কুলের দূরত্ব বেড়ে গেলে তার পক্ষে একা যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে আমাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাবে।

তার সন্তানকে যাতে অন্য স্কুলে না দেওয়া হয় সেটি প্রধান শিক্ষিকা আপাকে জানিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এক শিফটের ক্লাস রুটিনে দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আলাদাভাবে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে সকাল ৯টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর ১২টা ৫০ পর্যন্ত চলবে। দ্বিতীয় ধাপে চলবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস শুরুর আগে ৩০ মিনিট দৈনিক সমাবেশ আয়োজন করবেন শিক্ষকরা। প্রতিটি ক্লাসের সময়সীমা ৫০ মিনিট করে নির্ধারণ করা হলেও তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রথম ক্লাসের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ মিনিট।
জানতে চাইলে ডিপিইর সহকারী পরিচালক (বিদ্যালয়) নাসরিন সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি জাতীয়করণ হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারজন করে শিক্ষক পদ সৃজন রয়েছে। সেখানে নতুন করে শিক্ষকের পদ বাড়ানো হবে। এর বাইরেও অনেক পুরোনো বিদ্যালয়ে চার-পাঁচজন করে শিক্ষক রয়েছেন। এবার ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ২৬ হাজার শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিকে ও বাকিগুলো সহকারী শিক্ষক শূন্যপদে পদায়ন করা হবে। আগামী ২২ জানুয়ারি এসব শিক্ষক যোগ দেবেন। এতে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, যে সব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ রয়েছে সেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে এক শিফট চালু করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে এই দুই স্তরে সংকট রয়েছে তাদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এসব স্কুলের এক কিলোমিটারের মধ্যে দুই ভাগে এক শিফট করা যায় কি না সেটি যাচাই করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ তথ্য পাওয়ার পর তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানা যায়, সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টির বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চার হাজারের অধিক দু-তিন কক্ষবিশিষ্ট রয়েছে। সেখানে একটি রুম শিক্ষকদের বসার স্থান বানিয়ে বাকি কক্ষে পাঠদান করানো হচ্ছে। এগুলোতে এক শিফটে পাঠদান শুরু করা সম্ভব নয়। সে কারণে একসঙ্গে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফটে পাঠদান শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে একসঙ্গে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফটে পাঠদান শুরু করা যাবে না। আমরা স্ট্যাডি করে যেখানে যেখানে করা সম্ভব সেখানে করা হচ্ছে। যেখানে শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকট এবং পাশাপাশি বিদ্যালয় রয়েছে, ক্যাচমেন্ট এলাকা (যে অঞ্চল থেকে কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সদস্য সংগ্রহ করে) নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন করা হবে।
এক কিলোমিটারের মধ্যের অন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সমন্বয় করলে ইতিবাচক ফল আসবে কি না জানতে চাইলে সচিব বলেন, স্থানীয় বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি সারাদেশের জন্য কমন সিদ্ধান্ত নয়। কোথাও দুইশ গজের মধ্যে দুটি বিদ্যালয় রয়েছে, কোথাও ২০ জন আবার কোথাও চার-ছয়জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ ধরনের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যেখানে যেটা প্রয়োজন সেখানে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।



« (পূর্ববর্তী সংবাদ ..)



Related News

  • ছয় মাসের মধ্যে অবসরভাতা দিতে নির্দেশ হাইকোর্টের
  • এসএসসির প্রথম দিনে অনুপস্থিত ১৯ হাজার, বহিষ্কার ২৫
  • গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা
  • শিক্ষক নিয়োগে ই-রেজিস্ট্রেশন শুরু, শিগগির পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি
  • কামিল ১ম ও ২য় পর্ব পরীক্ষার ফল প্রকাশ
  • এইচএসসির ফল প্রকাশ আজ
  • তিন বিসিএসের ক্যাডার ও নন–ক্যাডারের ফল একসঙ্গে দিতে চায় পিএসসি
  • সাত কলেজের সিজিপিএ শর্ত শিথিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর
  • %d bloggers like this: